ধর্ম gita
 
ধর্ম, স্বধর্ম এবং যুগধর্ম

ধর্ম কী? স্বধর্মই বা কাকে বলে? এর উত্তরে বলা যায় যা সনাতন, যা ব্যষ্টির এবং সমষ্টির পক্ষে কল্যাণপ্রদ, তাই ধর্মোচিত কার্য। আর যা ব্যক্তির নিজস্ব গুণ এবং কর্মের পক্ষে অনুকূল তাই স্বধর্ম।

ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়।।

এই ঘোর কলিতে ধর্মপালন, বিশেষ ক’রে স্বধর্ম পালন করা অসম্ভব কঠিন একথা আজকাল অনেককেই বলতে শুনি। কিন্তু এই ব’লে দায় সেরে ফেলা এবং আপন কর্তব্য থেকে দূরে সরে থাকা স্রেফ অজুহাত-পরায়ণতা মাত্র; এ হচ্ছে পলায়নবাদ – কাপুরুষতার নামান্তর। ধর্মরক্ষা এবং স্বধর্ম পালন বীরপুরুষের কাজ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ধর্ম কী? স্বধর্মই বা কাকে বলে? এর উত্তরে বলা যায় যা সনাতন, যা ব্যষ্টির এবং সমষ্টির পক্ষে কল্যাণপ্রদ, তাই ধর্মোচিত কার্য। আর যা ব্যক্তির নিজস্ব গুণ এবং কর্মের পক্ষে অনুকূল তাই স্বধর্ম। প্রবল ইচ্ছাশক্তি, নিজের উপর অসম্ভব শ্রদ্ধা এবং আত্মবিশ্বাস না থাকলে পরে ধর্মপালন, স্বধর্ম রক্ষা এবং স্বীয় কর্তব্য কর্ম সম্পন্ন করা যায় না। এ অতি কঠিন কাজ। আমাদের সুমহান দেশ ভারতবর্ষ দেবভূমি, তাই এখানে যুগে যুগে এরকম কতিপয় ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছে যাঁরা যুগধর্মের ঊর্ধে উঠে জীবনের ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রবল প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েও আপন কর্তব্য কর্ম, স্বীয় ধর্মকার্য নিঃশব্দে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে গেছেন। তাই তাঁরা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কাছে ভগবৎতুল্য পূজনীয় হয়ে উঠেছেন। এমনই একজন মহাপুরুষ হলেন রঘুকুলতিলক ভগবান শ্রীরামচন্দ্র। তিনি ভারতবর্ষীয় মাত্রেরই পরমারাধ্য, পরমপূজনীয় – কারণ একাধারে তিনি আদর্শ পুত্র, আদর্শ পতি, আদর্শ ভ্রাতা, আদর্শ শিষ্য, আদর্শ ক্ষত্রিয়, এবং আদর্শ রাজা। এতগুলি আদর্শ তিনি রক্ষা করলেন কীভাবে? এই কঠিন ব্রত তিনি পালন করতে পেরেছিলেন, তার কারণ তিনি তাঁর জীবনের পৃথক পৃথক অবস্থায় – তা সে বাল্যকাল হোক বা কৈশোর, যৌবন হোক কিংবা প্রৌঢ়ত্ব, ব্রহ্মচারী দশায় হোক অথবা গার্হস্থে – সর্বদা আপন আশ্রমের মর্যাদা দিয়েছেন, সেই সেই আশ্রমের সময়োচিত কর্তব্য কর্ম পরম নিষ্ঠার সঙ্গে সম্পাদন করেছেন। হাজার অসুবিধে, বিরোধিতা, অপরের কুটিলতা – এগুলির কোনোটির দ্বারাই বিভ্রান্ত হননি, এই কারণগুলি দেখিয়ে অভিমান ভ’রে নিজের কর্তব্যকে অবহেলা করেননি। সাধারণতঃ মানুষ কাজের ক্ষেত্রে একটু প্রতিকূলতা দেখতে পেলেই নিজের কর্তব্য পালন করা থেকে বিরত হয়ে পড়ে। এ মানুষের স্বাভাবিক দুর্বলতা বটে, কিন্তু এটাই মনুষ্যচরিত্রের শেষকথা নয়। এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারলেই মানুষ দেবত্বে উত্তীর্ণ হতে পারে। ত্রেতাযুগে কাকুৎস্থ শ্রীরামচন্দ্র আদর্শ জীবন অতিবাহিত ক’রে আমাদের তা দেখিয়ে গেছেন। তাই মনুষ্যযোনিতে জন্মেও তিনি স্বয়ং জগৎপালনকর্তা নারায়ণের অবতাররূপে পূজ্য।

স্বধর্ম পালন ও রক্ষা চিরকালই কঠিন ব্যাপার ছিল, তা নাহ’লে ত্রেতাযুগে শ্রীরামচন্দ্রকে ক্ষাত্রধর্ম রক্ষার্থে কিশোর বয়সে ভাইয়ের সঙ্গে ঋষি বিশ্বামিত্রের ডাকে সাড়া দিয়ে তাড়কা বধ করতে যেতে হ’ত না; পুত্রের ধর্ম পালন ক’রে পিতৃসত্য রক্ষার জন্য সদ্যবিবাহিতা পরমাসুন্দরী যুবতী স্ত্রীকে সঙ্গে ক’রে চোদ্দ বছরের দুঃসহ বনবাসে যেতে হ’ত না; পতির ধর্ম রক্ষার্থে সেই স্ত্রীকে উদ্ধার করবার জন্য শূন্য থেকে শুরু ক’রে একখানি বিশাল সৈন্যবাহিনী খাড়া ক’রে রাবণ নামক ব্রহ্মা ও শিবের দৈব বরে পুষ্ট এক মহাশক্তিধর রাজাকে সম্মুখসমরে হারাতে হ’ত না; আর এত কষ্টের ফলে উদ্ধার করা প্রিয়া পত্নীকে রাজার ধর্ম রক্ষার্থে প্রজানুরঞ্জনের জন্য চিরতরে হারাতে হ’ত না। স্বধর্ম (স্ব-সংস্কৃতিও ধর্মেরই অঙ্গ) পালন এবং রক্ষা মনুষ্যজন্মের সবচাইতে কঠিন পরীক্ষা। তার চাইতে পরধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়া ঢের সহজ। কঠিন, দুর্গম পথকে এড়িয়ে সহজ রাস্তা ধরা মনুষ্যস্বভাবে স্বাভাবিকভাবেই আসে, তার জন্য আলাদা ক’রে আয়াস করতে হয় না। কঠোপনিষদ বলেছেন, ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দূরত্যয়া দুর্গম্ পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি। অর্থাৎ, মানবজীবনের চরম উদ্দেশ্য মুক্তি বা আত্মজ্ঞান লাভের পথ ক্ষুরধার, দুর্গম – একথাই কবিরা বলে থাকেন (এখানে ‘কবি’ অর্থে বেদমন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিগণ বুঝতে হবে)। নিষ্কাম হয়ে, অর্থাৎ কর্মফলের চিন্তা না ক’রে স্বধর্ম যথাযথ ভাবে পালন করলে তবেই কর্মযোগে সিদ্ধিলাভ হয়, জন্ম-মৃত্যুর জাঁতাকল থেকে বেরিয়ে পরমার্থ মোক্ষের প্রাপ্তি ঘটে। এ বড় সহজ পথ নয়। এখানে শ্রীমদ্ভগবদগীতার সাবধানবাণী মনে রাখা দরকার : স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ। স্বধর্ম কষ্টকর হতে পারে, এমনকী জীবন দিয়ে স্বধর্ম রক্ষার মুল্য দিতে হতে পারে, কিন্তু পরধর্ম ভয়াবহ কারণ তাতে ভয়াবহ অধোগতি প্রাপ্ত হ’তে হয়, যা থেকে উদ্ধার পেতে লক্ষ লক্ষ বছর সময় লাগে। শ্রীশ্রী গীতা আরও বলেছেন, শ্রেয়ান্‌ স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ – অর্থাৎ “স্বধর্ম (নিজ জাতি [অর্থাৎ জন্ম, বংশ, কুল ইত্যাদি] বা স্বভাবের অনুযায়ী কর্মসংবলিত ধর্ম) বিগুণ হলেও (অপর ধর্মের তুলনায় তাতে বাঞ্ছিত গুণের অভাব থাকলেও) সু-অনুষ্ঠিত (অনায়াসে অনুষ্ঠিত, কিংবা লৌকিক দৃষ্টিতে সুন্দর অনুষ্ঠানযুক্ত) পরধর্মের চেয়ে শ্রেয় (অধিক হিতকর)।”[1] এই প্রসঙ্গে শ্রীমদ্ভগবদগীতার আরেকটি অমোঘ শ্লোক স্মরণীয়। এই শ্লোকটির দেখা মেলে শ্রীশ্রী গীতার সাংখ্যযোগ নামক দ্বিতীয় অধ্যায়ে, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ অবসন্ন অর্জুনকে ক্রমাগতঃ যুদ্ধের জন্য প্রবৃত্ত করছেন। নানা দিক থেকে যুক্তির অবতারণা ক’রে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর কর্তব্য যুদ্ধের জন্য প্রণোদিত করছেন, এরকমই একটি যুক্তি হিসেবে ভগবান ব’লে উঠলেন –

স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি।

ধর্মাৎ হি যুদ্ধাৎ শ্রেয়ঃ অন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে।।

– শ্রীমদ্ভগবদগীতা২.৩

ব্যাখ্যার এবং বোঝার সুবিধে হবে তাই এখানে সংস্কৃত পদগুলির সন্ধি বিচ্ছেদ ক’রে শ্লোকটি উল্লেখ করলাম। শ্রীরাজশেখর বসু এই শ্লোকটির বঙ্গানুবাদ করেছেন এইভাবে – “আর, স্বধর্ম দেখেও (স্বধর্মের কর্তব্য বুঝেও) তুমি বিকম্পিত [বিচলিত] হ’তে পার না; কারণ ধর্ম্য[2] যুদ্ধের চেয়ে ক্ষত্রিয়ের আর অন্য শ্রেয় নেই।” পাঠক খেয়াল করবেন যে গীতার শ্লোকগুলিতে ‘শ্রেয়’ শব্দটি ফিরে ফিরে আসে। ভারতবর্ষের সনাতন চিন্তা ও সংস্কৃতিতে শ্রেয় এবং প্রেয় একটি ধ্রুব দ্বন্দ্ব – যেমন ভোগ এবং ত্যাগ, অসুর এবং দেবতা, অধর্ম বনাম ধর্ম, তমসা বনাম জ্যোতি – তেমনই প্রেয়ের সাপেক্ষে শ্রেয়। প্রেয় লাভ করা অপেক্ষাকৃত সহজতর, কারণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি স্বাভাবিকভাবেই প্রেয়ের পানে ধায়। শ্রেয়লাভ অনেক কঠিন; তার জন্য সাধনা করতে হয়, দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয় – আপনা থেকে এসে সে ধরা দেয় না। গীতায় বর্ণিত বিষণ্ণ ক্লীব অর্জুন কৌরবপক্ষে নিজ আত্মীয়-পরিবারবর্গকে দণ্ডায়মান দেখতে পেয়ে “ন যোৎস্য” – যুদ্ধ করব না ব’লে রথের উপর বসে পড়েছিলেন – কারণ তেমনটা করা সহজ ছিল। তারপর প্রায় সাড়ে ছ’শো শ্লোক জুড়ে শ্রীকৃষ্ণকে উপদেশ দিতে হয়েছিল অর্জুনকে যুদ্ধে প্রণোদিত করতে, অর্জুনের নানাবিধ জটিল প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছিল, এবং শেষমেশ নিজের ভগবৎস্বরূপটিও অব্দি প্রকাশ করতে হয়েছিল – তবেই গিয়ে অর্জুন আবার গাণ্ডীব হাতে তুলে নেন। অর্থাৎ ধর্মের পথ থেকে বিচ্যুত হ’তে চলা অর্জুনকে পুনরায় নিজের স্বধর্মে প্রতিষ্ঠিত করতে পার্থ এবং পার্থসখা উভয়কেই যথেষ্ট কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। এটাই নিয়ম – স্বধর্ম পালন করবার পথটি প্রশস্ত নয়, গোলাপ-বিছানো নয় – বরং কণ্টকাকীর্ণ।

প্রবৃত্তি যেহেতু ইন্দ্রিয়ের বশংবদ, এবং ইন্দ্রিয় যেহেতু স্বভাবতঃই বহির্মুখী – কারণ শরীরজ ইন্দ্রিয় বহির্জগতের উপাদান পঞ্চভূতের তৈরি, তাই প্রবৃত্তি সদা চঞ্চল এবং স্বতঃ বহির্গামী। এখানে মনে রাখা দরকার যে ভারতীয় চিন্তায় ‘মন’ একখানি ইন্দ্রিয় বৈ আর কিছু নয় – চোখ নাক কানের মতো কর্মেন্দ্রিয়ের সাথে মন আর একখানি ইন্দ্রিয় – যা স্বতন্ত্র নয়। স্বতন্ত্র একমাত্র আত্মা, যিনি সবকিছুকে নিজের বশীভূত করতে সক্ষম, কিন্তু সেজন্যে আত্মাকে নিজের স্বরূপ উপলব্ধি করতে হয় – আপনাতে আপনি প্রতিষ্ঠিত হ’তে হয়, মগ্ন হ’তে হয়। যে জীব সেই প্রতিষ্ঠা এখনো লাভ করে উঠতে পারেননি, তাঁকে সেই লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য নিষ্ঠা এবং শ্রদ্ধার অবলম্বন করতে হয়। জ্ঞান, কর্ম, ভক্তি এবং রাজযোগ – এই চতুর্বিধ পথের যেকোনো একটি অথবা একাধিক পথ অবলম্বন করে জীব আপন সত্যস্বরূপ আত্মায় প্রতিষ্ঠিত হ’তে পারেন। এগুলির মধ্যে জ্ঞানযোগ হচ্ছে সরাসরি লক্ষ্যে পৌঁছনোর পথ, কারণ জ্ঞানশলাকা নিমেষে অজ্ঞানান্ধকার দূর করে – ঠিক যেন মেঘাচ্ছন্ন রাত্রের ঘন অন্ধকারের মধ্যে সৌদামিনীর ঝলক। তাই ব’লে জ্ঞানমার্গকে সহজ পথ ভাবলে ভুল হবে, কারণ দৃঢ় অধ্যবসায় ও নিষ্কম্প শ্রদ্ধা না থাকলে জ্ঞানমার্গের যে পথ – অর্থাৎ শ্রবণ, মনন এবং নিদিধ্যাসন – তা পেরনো সম্ভব নয়। ব্রহ্মচর্যব্রতের কঠোর জীবন জ্ঞানমার্গের জন্য নির্দিষ্ট। রাজযোগ অতি গুহ্য এবং তেমনই কঠিন। কর্মযোগ দাবী করে নিষ্কামভাবে আপন কর্তব্যপালন – কিন্তু কজনই বা পারে কর্মফলের কামনা ত্যাগ ক’রে সুষ্ঠুভাবে কর্ম সম্পাদন করতে? তাই শুভাশুভ সকল কর্মফল ঈশ্বরে অর্পিত ক’রে “তাঁর পূজা করছি” এই মনোভাব নিয়ে কর্ম করলে একই লক্ষ্যে পৌঁছনো যায় – আর এই পথকেই বলে ভক্তি। কলিযুগে এই ভক্তির পথ প্রশস্ত – হৃদয়ে অপার প্রেম থাকলে ভক্ত নিজের সবকিছু ভগবানের পাদপদ্মে সমর্পণ করে উদ্ধারলাভ করতে পারেন। কিন্তু ভক্ত হবার অর্থ কর্তব্যকর্মে অবহেলা করা নয় – বরং কাজের মধ্যে দিয়ে তাঁর পূজা সম্পন্ন করা। খাওয়া, শোওয়া, দান-ধ্যান সবই তাঁর উদ্দেশ্যে অর্পণ করছি – ভক্তিমার্গে এই মনোভাব চাই। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন :

যৎকরোষি যদশ্নাসি যজ্জুহোষি দদাসি যৎ।

যৎ-তপস্যসি কৌন্তেয় তৎকুরুষ্ব মদর্পণং।।

– শ্রীমদ্ভগবদগীতা ৯.২৭

বঙ্গানুবাদে দাঁড়ায় – “হে কৌন্তেয় [অর্থাৎ কুন্তীপুত্র – অর্জুন], যা কর, যা খাও, যে হোম কর, যে দান কর, যে (যার জন্য) তপস্যা কর, তা আমাকে অর্পণ কর।” এই হচ্ছে ভক্তির সারকথা। অর্জুনকে ভক্তির এই অপূর্ব তত্ত্ব বুঝিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আশ্বাস দিয়েছেন – এবং এই আশ্বাস যুগে যুগে যত ভক্ত হয়েছেন বা হবেন, তাঁদের সকলেই উদ্দেশ্য ক’রে দেওয়া –

অনন্যাশ্চিন্তয়ন্তো মাং যে জনাঃ পর্যুপাসতে।

তেষাং নিত্যাভিযুক্তানাং যোগক্ষেমং বহাম্যহম্‌।।

– শ্রীমদ্ভগবদগীতা ৯.২২

অর্থাৎ, “অনন্যমনে চিন্তা (ধ্যান) ক’রে যে সকল লোক আমার উপাসনা করেন, নিত্য অভিযুক্ত তাঁদের যোগক্ষেম (অপ্রাপ্ত বস্তুর প্রাপ্তি ও প্রাপ্ত বস্তুর রক্ষা) আমি বহন করি…”। এই আশ্বাস চিরকালীন, যা ঘোর দুঃসময়ে ভক্তের হৃদয়ে ভরসা যোগায় এবং তাঁকে সত্য-ধর্মপথে রাখে। শ্রীহরির আশ্বাস স্মরণ ক’রে যুগে যুগে ভারতবর্ষের পুণ্যভূমিতে কর্মবীর ব্যক্তিগণ অক্ষয় কীর্তি স্থাপন ক’রে গেছেন। সংখ্যায় নগণ্য হ’লেও প্রত্যেক যুগেই এঁদের আবির্ভাব হয়ে থাকে; প্রত্যেক যুগের মানুষের সামনেই তাঁরা আদর্শ ধর্মজীবনের দৃষ্টান্ত স্থাপন ক’রে থাকেন – এই যা ভরসার কথা।  পুণ্য কর্ম, মঙ্গলপ্রদ, কল্যাণকর কর্ম সম্পাদনে তাঁরা স্বর্গসুখের আকাঙ্ক্ষা করেননা; বরং কর্তব্যবোধেই সেসকল কর্ম তাঁরা নিষ্ঠা এবং যত্নসহকারে সেরে থাকেন। “এ কাজের স্বীকৃতি আমায় কে দেবে?” “যে লোককল্যাণকর কাজ করলাম, তার জন্য লোকে আমার প্রতি কৃতজ্ঞ বোধ করে না কেন?” – এই জাতীয় প্রশ্নের উত্থাপন তাঁরা করেন না। কল্যাণপ্রদ কর্ম করা কর্তব্য, এই জেনেই তাঁরা সে কর্তব্যের সমাধা করে থাকেন; আর সে কর্মের ফল ঈশ্বরে অর্পণ করেন। ঈশ্বরকে কর্ম ও তার শুভাশুভ, সফলতা-ব্যর্থতা, প্রশংসা-নিন্দা ইত্যাদি যাবতীয় ফলাফল অর্পণ করলে কাজ হয়ে দাঁড়ায় তাঁর উপাসনা। ঈশ্বরোপাসনা কি আর যেমন-তেমন ক’রে করা যায়? সেজন্য ধৈর্য, নিষ্ঠা, যত্ন এবং সর্বোপরি প্রেমের দরকার পড়ে। উপাসনা তো ভালবাসারই আরেক নাম। উপাস্য সেখানে ভালবাসার বস্তু। আর সে উপাসনার লক্ষ্য যেহেতু তিনি, তাই তার ফল হিসেবে শেষে তাঁকেই লাভ করা হয়। তাঁকে লাভ করলে আর বন্ধন থাকে না, মোহ ঘুচে যায়, জীবের মুক্তি ঘটে।

শ্রীবাসুদেবের সম্পর্কিত এই লেখা, শ্রীবাসুদেবেরই চরণকমলে সমর্পণ করা গেল। হরি ওঁ তৎ সৎ।।

[1] অনুবাদ শ্রীরাজশেখর বসু-কৃত, […] বন্ধনীর মধ্যে যা রয়েছে তা বর্তমান লেখকের নিজস্ব সংযোজনা। পরবর্তী উদ্ধৃতিগুলির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। যে সংস্করণটি এখানে ব্যবহৃত হয়েছে তা হ’ল শ্রীমদ্ভগবদ্‌গীতা (ভূমিকা, মূল শ্লোক, অন্বয় ও অন্বয়ানুগামী অনুবাদ-সহ), রাজশেখর বসু, এম.সি. সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিঃ, কলকাতা।

[2] অর্থাৎ ধর্মোচিত, ধর্মসম্মত। দয়া এর সঙ্গে আব্রাহামীয় সম্প্রদায়গুলির ‘ক্রুসেড’কে – যাকে অসাবধানতাবশতঃ বাংলায় ধর্মযুদ্ধ ব’লে অনুবাদ করা হয়ে থাকে, ঠিক যেমন রিলিজিয়নকে বাংলায় ধর্ম ব’লে চালানো হয় সেইভাবে – গুলিয়ে ফেলবেন না।

Featured Image: Bhagavad Gita US

Disclaimer: The facts and opinions expressed within this article are the personal opinions of the author. IndiaFacts does not assume any responsibility or liability for the accuracy, completeness,suitability,or validity of any information in this article.